দুবাই গ্লোবাল ভিলেজ এক দিনে বিশ্ব ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
- ভূমিকা
- গ্লোবাল ভিলেজের সূচনা ও ইতিহাস
- অবস্থান ও মৌসুম
- প্রবেশ পথ, টিকিটের মূল্য ও ভেতরের পরিবেশ
- দেশভিত্তিক প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- বাংলাদেশি প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- পাকিস্তানি প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- ভারত প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- তুরস্ক প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- ইরান প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- আফ্রিকান প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- ইউরোপীয় প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- কেনাকাটা
- বিনোদন ও অনুষ্ঠান
- ভ্রমণ টিপস
- কার্নিভ্যাল ও রাইড
- উপসংহার
ভূমিকা
দুবাই সবসময়ই বিশ্ববাসীকে চমকে দিয়েছে তার আধুনিক স্থাপত্য, বিলাসবহুল জীবনযাত্রা এবং অসাধারণ পর্যটন ব্যবস্থার মাধ্যমে। কিন্তু এই শহরের আসল বৈচিত্র্য ও সংস্কৃতির স্বাদ পাওয়া যায় এক বিশেষ স্থানে "দুবাই গ্লোবাল ভিলেজে"। এখানে ভ্রমণ মানে একসাথে পৃথিবীর নানা দেশের সংস্কৃতি, খাবার, কেনাকাটা এবং বিনোদনের স্বাদ নেওয়া।
গ্লোবাল ভিলেজে প্রবেশ করার মুহূর্তেই মনে হয় যেন পৃথিবীর প্রতিটি দেশ আপনার হাতের নাগালে চলে এসেছে। প্রায় ৯০টিরও বেশি দেশের প্রতিনিধিত্ব এখানে আছে, আর প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য, শিল্প, পণ্য এবং খাবার দিয়ে ভ্রমণকারীদের স্বাগত জানায়।
গ্লোবাল ভিলেজের সূচনা ও ইতিহাসঃ
গ্লোবাল ভিলেজের যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৭ সালে। প্রথমদিকে এটি ছিল একটি ছোট আকারের আয়োজন, যেখানে মাত্র কয়েকটি কিয়স্ক এবং দোকান স্থাপন করা হয়েছিল দুবাই ক্রীক ও ওয়াফি সিটির কাছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দর্শনার্থীদের ভিন্ন ভিন্ন দেশের পণ্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করানো।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। বর্তমানে এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মাল্টি কালচারাল পার্কে পরিণত হয়েছে। এখন প্রতি মৌসুমে প্রায় ৭ মিলিয়নেরও বেশি দর্শনার্থী এখানে ভ্রমণ করেন।
অবস্থান ও মৌসুমঃ
গ্লোবাল ভিলেজ অবস্থিত দুবাইয়ের শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ রোডে। এটি মৌসুমভিত্তিক খোলা থাকে। সাধারণত অক্টোবরের শেষ থেকে এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত এর আয়োজন চলে। কারণ দুবাইয়ের শীতকাল ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে আরামদায়ক সময়।
প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এটি খোলা থাকে, আর সপ্তাহান্তে সময়সীমা বেড়ে যায় রাত ১টা পর্যন্ত।
প্রবেশ পথ, টিকিটের মূল্য ও ভেতরের পরিবেশঃ
গ্লোবাল ভিলেজে ঢুকতেই বিশাল গেট, আলো ঝলমলে সাজসজ্জা আর সাংস্কৃতিক সংগীত ভ্রমণকারীদের অন্যরকম অনুভূতি দেয়। প্রবেশমূল্য সাধারণত ২০ থেকে ২৫ দিরহাম। মৌসুমভেদে সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। শিশু, বয়স্ক ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্নদের জন্য অনেক সময় ছাড় দেওয়া হয়।প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করে প্যাভিলিয়নের মাধ্যমে।
দেশভিত্তিক প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরনঃ
বাংলাদেশি, ভারত, পকিস্তান, চীন, তুরস্ক, ইরান, আফ্রিকান, ইউরোপীয় ইত্যাদি প্যাভিলিয়নের পণ্যের ধরন নিম্নে দেয়া হলোঃ
বাংলাদেশি প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
২০১৯ সালে প্রথমবার বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন গ্লোবাল ভিলেজে উদ্বোধন করা হয়।
- হস্তশিল্পঃ জুট/কাঠ/কাঁচের হস্তনির্মিত পণ্যের সামগ্রী, ঘরের সাজানোর আইটেম, পোশাক
- বস্ত্র ও ফ্যাব্রিকঃ জামদানি, তাঁতের বা টাঙ্গাইলের বস্ত্র, সিল্ক/কটন শাড়ি, সাধারণ পোশাক
- খাবার ও শুকনো পণ্যঃ বাংলাদেশী মশলা, শুকনো ফল, চিড়া, বিভিন্ন ধরনের নাস্তাহার, মিষ্টান্ন
পাকিস্তানি প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
- Hamdan Classic Textile Pakistan Pavilion 2, Shop 11-12 বস্ত্র, কাপড়ের মেটেরিয়াল, টেক্সটাইল প্রোডাক্ট
- Noor Al Jamal Trading Pakistan Pavilion 2, Shop 4 মহিলা বিভাগের পোশাক
- Kashmir Handicrafts Pakistan Pavilion 2, Shop 26 হস্তশিল্প, পর্দা, কৃষ্ণশিল্প পণ্য, গহনা ইত্যাদি
ভারত প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
এটি গ্লোবাল ভিলেজের অন্যতম সবচেয়ে রঙিন ও প্রাণবন্ত প্যাভিলিয়ন।
- পোশাক ও ফ্যাশনঃ শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, লেহেঙ্গা, কুর্তা, শেরওয়ানি
- হস্তশিল্পঃ রাজস্থানি কাঠের পুতুল, কাশ্মীরি শাল, পিতলের তৈরি সামগ্রী
- খাদ্যঃ মশলা, আচার, শুকনো ফল, ভারতীয় চা
তুরস্ক প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
তুরস্ক প্যাভিলিয়ন (Turkey Pavilion) গ্লোবাল ভিলেজ, দুবাইতে একটা বড় আকর্ষণ।
- হস্তশিল্প ও সজ্জাসামগ্রীঃ মোজাইক ল্যাম্পস, সিরামিক, কুপার এবং পর্তুগালের নিচের নকশায় তৈরি বস্তু, হ্যান্ডমেইড পাত্র-বাসন ও সাজ-সজ্জার সামগ্রী
- খাবার ও মিষ্টান্নঃ Turkish delights, baklava, Turkish coffee, Turkish ice cream (“dondurma”), বিভিন্ন মশলা ও পুষ্টিকর খাবার
- সুগন্ধি & সৌন্দর্যঃ রোজ ওয়াটার, সুগন্ধি তেল, প্রাকৃতিক ও বোদি ফ্রাগ্রেন্সস
ইরান প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
ইরান প্যাভিলিয়নের বিশেষ দিকসমূহ প্যাভিলিয়নটা সাজানো হয়েছে পারস্য ঐতিহ্য ও স্থাপত্যের রূপ নিয়ে
- পারস্য কর্পেটঃ রেশম ও উলের মিশ্রণ, নিখুঁত নকশা, বিভিন্ন আকারে পাওয়া যায়।
- শুকনো ফল, বাদাম ও মিষ্টিঃ পেস্তার্চিও, আলমন্ড, সাফরন-মিশ্রিত বাদাম, সুগন্ধি মিষ্টি, “sohan” ইত্যাদি।
- শেহরি চা (Persian Tea), Rose Water ঃ সুগন্ধি চা ও রোজ ওয়াটার পাওয়া যায়; খাবার ও নাস্তার লগ্নে ভালো বিকল্প।
- হাতের কাজঃ মারকেট্রি, মিনি সুইট পেইন্টিং, কলিগ্রাফি প্যাম্পলেট বা বাড়ির সজ্জার প্যানেল।
আফ্রিকান প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
আফ্রিকান প্যাভিলিয়ন দুবাই গ্লোবাল ভিলেজের একটা খুবই রঙিন ও বিশেষ অংশ। এখানে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে এনে সাজ-সজ্জার জিনিস, খাবার, পারফিউম, হস্তশিল্প সব মিলিয়ে একটা “সাংস্কৃতিক সফর” পাওয়া যায়। নিচে বিস্তারিত দিচ্ছি—কি কি আছে, কি কেনা যায়, এবং কিছু দোকান-বিস্তার:
- Mercato Africa ঃ African Pavilion, Shop 13 পারফিউম, wigs / hair accessories, সৌন্দর্যপণ্য
- Gelela ঃ African Pavilion, Shop 23 Beauty products / perfumed items etc.
ইউরোপীয় প্যাভিলিয়ন ও পণ্যের ধরন
ইউরোপ প্যাভিলিয়ন (Europe Pavilion) দুবাই গ্লোবাল ভিলেজের একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় অংশ। এখানে ইউরোপের নানা দেশ, তাদের পণ্য, সংস্কৃতি ও খাবারের রুচি মিলেমিশে এমন একটা জায়গা বানায় যা “মিনি ইউরোপ” অভিজ্ঞতার মতো। নিচে সব দিক থেকে বিশ্লেষণ ।
- খাবার ও পানীয়ঃ ইতালিয়ান পাস্তা, স্প্যানিশ টাপাস, জার্মান সসেজ, ইউরোপিয় স্টাইল পেস্ট্রি ও পিঠা-পান, উদ্যোক্তা ফরাসি বা ইতালি থেকে আসা খাবার সামগ্রী।
- ফ্যাশন ও পোশাকঃ ইউরোপীয় ডিজাইনের পোশাক, বিদেশি ফ্যাশন ব্র্যান্ড, মহিলাদের জুতো ও আনুষাঙ্গিক।
- খাদ্য উপাদান ও খাবার সামগ্রীঃ ওলিভ অয়েল, মধু (honey), প্রচলিত European ধরনের বেকারি পণ্য, পাস্তা ইত্যাদি।
- কাস্টম আর্ট ও পারফরমেন্সঃ লন্ডনের স্টাইল স্ট্রিট পারফরমেন্স, ঐতিহ্যবাহী ইউরোপীয় নৃত্য, স্টাইল-ভিত্তিক ফ্যাশন প্রদর্শনী, ইতিহাসভিত্তিক পোশাক ও ছবি তোলার স্টুডিও।
আরও পড়ুনঃআইফোন ও অ্যান্ড্রয়েড ফোন এর মধ্যে আসল পার্থক্য কোথায়
কেনাকাটাঃ
গ্লোবাল ভিলেজ হলো শপাহলিকদের জন্য স্বর্গ। এখানে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আনা অসংখ্য পণ্য পাওয়া যায়।
- কাশ্মীরি শাল
- তুর্কিশ কার্পেট
- মরক্কোর আরগান অয়েল
- আফ্রিকার অলংকার
- মিশরের সুগন্ধি
- জাপানি কিমোনো
- ইরানি গালিচা
দর কষাকষি করার সুযোগও আছে, তাই অনেকেই এখানে শপিং করতেই আসেন।
বিনোদন ও অনুষ্ঠানঃ
- গ্লোবাল ভিলেজে প্রতিদিন অসংখ্য অনুষ্ঠান হয়।
- আন্তর্জাতিক নাচ ও সংগীত পরিবেশনা
- স্টান্ট শো (মোটরবাইক, গাড়ির প্রদর্শনী)
- শিশুদের জন্য কার্টুন চরিত্র শো
- লাইভ কনসার্ট
- আতশবাজি প্রদর্শনী
ভ্রমণ টিপসঃ
- প্রথমবার গেলে কিছু বিষয় মাথায় রাখা ভালো:
- সন্ধ্যায় যান, আলো ঝলমলে পরিবেশ তখন সবচেয়ে আকর্ষণীয়।
- আরামদায়ক জুতো পরুন, কারণ হাঁটাহাঁটি অনেক করতে হবে।
- হাতে কিছু ক্যাশ রাখুন।
- খাবারের জন্য আগে ঘুরে দেখে নিন কোথায় কী পাওয়া যাচ্ছে।
- উইকেন্ডে ভিড় বেশি থাকে, তাই চাইলে সপ্তাহের মাঝের দিনে যেতে পারেন।
কার্নিভ্যাল ও রাইডঃ
গ্লোবাল ভিলেজে বাচ্চাদের জন্য বিশাল কার্নিভ্যাল পার্ক রয়েছে। এখানে ফেরিস হুইল, রোলার কোস্টার, বাম্পার কার, ভিডিও গেমসসহ অসংখ্য রাইড আছে। পরিবারসহ ভ্রমণকারীদের জন্য এটি এক দুর্দান্ত জায়গা।
উপসংহারঃ
দুবাই গ্লোবাল ভিলেজ ভ্রমণ মানে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এখানে আপনি একই দিনে মরক্কোর আরগান অয়েল কিনতে পারবেন, ভারতের বিরিয়ানি খেতে পারবেন, আফ্রিকার ড্রামে নাচতে পারবেন, আবার রাতের শেষে ইউরোপীয় আতশবাজি উপভোগ করতে পারবেন।
গ্লোবাল ভিলেজের আসল সৌন্দর্য এখানেই—এটি মানুষকে একত্রিত করে, বৈচিত্র্যকে উদযাপন করে এবং পৃথিবীর রঙিন সংস্কৃতিকে সহজভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরে।
সানজীদ বর্ষার নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url